ডেস্ক রিপোর্ট
:রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার গঠিত ছয় কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গতকাল কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এরপর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বিষয়ে ব্রিফ করেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় তিনি বলেন, প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আলোচনা শুরু করতে চাই। তিনি বলেন, কমিশনগুলো আশু করণীয়, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি তিন ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আশু করণীয়গুলো আমাদের কাছে আলাদাভাবে দিয়েছে। সেটিও কতোদিনে করা উচিত সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে সেগুলো করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। আশু করণীয়র মধ্যে কিছু কিছু ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে। আবার কিছু বিষয় প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্যের লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আলোচনা শুরু হবে। এ ব্যাপারে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এটি করবে। এ সময় তিনি ৬ কমিশনের আশু করণীয়র মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো পড়ে শোনান।
জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রে আশু করণীয় মধ্যে রয়েছে- স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন করে আচরণবিধি প্রণয়ন, সরকারি সেবাখাত ডিজিটাল রূপান্তর, নাগরিক সেবা দেয়া সব দপ্তরের নিয়মিত গণশুনানি, জবাবদিহিতার জন্য স্থায়ী নাগরিক কমিটি গঠন, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগ করা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে রাখা, বিনিয়োগ-অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগকে একটি প্রতিষ্ঠান করা, কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করা, ১০ বিভাগের আয়তনের পুনর্বিন্যাস, জেলা প্রশাসককে জেলা কমিশনার ও উপজেলা প্রশাসককে উপজেলা কমিশনার করা, উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কার, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকে ডিজিটাল করা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাধারণ) করা ইত্যাদি। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের আশু করণীয়র মধ্যে রয়েছে- অধীনস্থ আদালতের বিচারকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়ন, জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের জন্য আচরণ বিধিমালা জারি, উপজেলা পর্যায়ের সিনিয়র সহকারী জজ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্থাপন, স্থায়ী জাতীয় অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, ফৌজদারি মামলার তদন্তে স্থায়ী ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন, বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা, অধস্তন আদালতে আইটি শাখা স্থাপন, জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে আদালতের সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ, ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ, নারী ও শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র স্থান আদালতে, অনলাইনে সরকারি সাক্ষ্য নিশ্চিত করা, আদালত প্রাঙ্গণে রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ, আদালতে অনলাইনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করা, ভুয়া সাক্ষী ও আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিধি, বিদ্যমান মামলার হ্রাসকল্পে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা জট এড়াতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ, বিচারপ্রার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, আইনজীবীদের ফি নির্ধারণে লিখিত চুক্তি ও রসিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা, মিথ্যা ও হয়রানি মামলা প্রতিরোধে পরামর্শ করা ইত্যাদি।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের আশু করণীয়র ক্ষেত্রে বলা আছে- পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্র ইউনিট, মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দেয়া, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, আচরণবিধি প্রণয়ন করা, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আসলে সেটি মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা ইত্যাদি। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দেয়া আশু করণীয় প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন, জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন করা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা এবং প্রার্থীর হলফনামা খসড়া এবং স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করা। এ ছাড়াও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও কিছু আশু করণীয়র কথা বলা হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, পোস্টাল ব্যালট পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, অনলাইন ভোটিং পরীক্ষা নিরীক্ষা করা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের দেয়া আশু করণীয় প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশল বাস্তবায়নে ন্যায়পাল নিয়োগ, কালো টাকা সাদা করার পদ্ধতি চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করা, প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা, কনপ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করা, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও ঘুষ লেনদেনকে শাস্তির আওতায় আনা ইত্যাদি। এ ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন আশু করণীয় দেয়া হয়নি। সব প্রস্তাব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংশোধন করা হবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ইসলাম বলেন, কমিশনগুলো আমাদের তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে। একটি আশু করণীয়, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদিটা নির্বাচিত সরকার করবে। মধ্যমেয়াদিটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা হবে। আর আশু করণীয়ের মধ্যে আমরা করতে পারবো। কিছু কিছু কাল থেকেই করা সম্ভব।
কমিশনগুলো বলেছে আশু করণীয় ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করার। আশু করণীয়ের আলোচনার বিষয় না। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে সেগুলো নিয়েও আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও আগে অনেক ভালো সংস্কার করেছে। প্রতিটা দলেরও নিজস্ব সংস্কার পরিকল্পনা আছে। তিনি বলেন, আমাদের অযথা সময় নষ্ট করে সরকারে থাকার ইচ্ছে নেই। আমরা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য ও রাষ্ট্র মেরামতের জন্য মৌলিক সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে চলে যেতে চাই। সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমাদের নেই। এ সময় জুলাই ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি একটি প্রস্তুত করেছে। তারা জোট সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্য বেগবান করার চেষ্টা করবেন সবাই। এটা কোনো আইনি দলিল নয়। এটি আমাদের ঐক্যের দলিল। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন চলতি বছরের ২২শে ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের ২২শে জুন হতে পারে।